সাপ্লাই চেনের মাধ্যমে আসা তুলা শনাক্তকরণ
একটি ছোট দলের সঙ্গে সম্প্রতি আমি ভারত সফরে যাই। দিল্লির তুলা বাজার দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা একটি জিনিস লক্ষ্য করলাম। গাড়ির জানালা খুলে দেখলাম, প্রচুর ও বিভিন্ন ধরনের পণ্য যেগুলো রাস্তার পাশেই তৈরি করা হয়েছে। আরেকটি এলাকা নিয়ে আমাদের সবারই আগ্রহ তৈরি হলো। সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে এমন দেখতে বিভিন্ন ধরনের খেজুর বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে একত্রিত করে। গাড়ির জানালা বেশি ফাঁক করে খেঁজুরের বাক্সে লেখা নাম পড়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কোন দেশে উৎপাদিত। এ সময় গাড়ির পেছনের আসনের বসা কিছু লোক উচ্চস্বরে টিপ্পনী কেটে বলতে লাগলেন ‘এটা শুধু একটি বাক্সই।’
শনাক্তকরণ, স্বচ্ছতা ও খাঁটিত্বের সব প্রশ্ন ওই পাঁচটি শব্দের একটি ছোট বাক্য ‘এটা শুধু একটি বাক্সই’-এর মধ্যে নিহিত। আরও বর্ণনা দিলে পরিষ্কার হওয়া যাবে। একটু পরেই রাস্তায় নেমে আমরা দেখলাম, বিক্রেতারা শুধু খালি বাক্স বিক্রি করছেন যেগুলোতে আগে বিভিন্ন কোম্পানির খেঁজুর ছিল। কিন্তু এটা আমরা আগে বুঝতে পারিনি। তাই এখন ঘোরতর প্রশ্ন মনে জেগেছে, বাক্সগুলোতে আসলেই কী ছিল? আসল কোম্পানির পণ্য ছিল সেখানে?
আপনি কি জানেন, আপনি কি বিশ্বাস করেন, আপনি কি বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারবেন, আপনি কি নিশ্চিত, কারা আপনাকে বিশ্বাস করেন, পণ্যটাই বা কি? এসব ভালো প্রশ্নের উত্তর টেক্সটাইল সাপ্লাই চেনে পাওয়া খুবই কঠিন। সহজাতভাবেই ভোক্তারা পণ্য সনাক্ত করতে ও পণ্যের মান যাচাই করতে তুলাসহ কৃষিপণ্যের প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি (লেবেল) দেখেন। পণ্য পরিচিতি সব সময়ই প্রথাগত বাজারজাতকরণের (সাপ্লাই চেনের সব পর্যায়ে) ওপরই নির্ভরশীল। সবশেষ বিক্রেতা পণ্যের বিষয়ে যা বলবেন সেটাই বিশ্বাস করে নিতে হবে, এটাই তাদের আসল পণ্য। সতেজ খাদ্যপণ্যে খুবই কম সাপ্লাই চেন থাকে। কিন্তু তুলা ও প্রাকৃতিক তন্তুর ক্ষেত্রে পুরোপুরি ভিন্ন। তুলা সংগ্রহ থেকে শুরু করে চূড়ান্তভাবে খুচরা বিক্রেতার দোকানের সেলফে ওঠা পর্যন্ত তুলার আঁশ একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতবদল হয়ে অনেক দূরে পৌঁছে যায়। স্পিনিং মিলের জন্য তুলা যখন প্রথমে জাহাজে তোলা হয়, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেউই জানেন না এর গন্তব্য কোথায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রম আছে। তবে সেটা গোণায় ধরা যায় না। তবে এই সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই, সাপ্লাই চেনের মাধ্যমে আসা পণ্যের স্বচ্ছতা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একটি নামকরা খুচরা প্রতিষ্ঠান একটি বিদেশী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ পণ্য আমদানি করছিল। পণ্যগুলোর গায়ে নির্দিষ্ট ও নামকরা উপাদানের পরিচিতি সেঁটে দেওয়া হয়। কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেল, পণ্যের গায়ে যে পরিচিতি দেওয়া হয়েছে, যে পণ্য বলে বিক্রি করা হয়েছে, সেটার সঙ্গে প্যাকেটের ভেতরে থাকা পণ্যের কোনো মিল নেই। এই বিষয়টি খুচরা ব্যবসায়ী, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও পণ্যের উৎপাদনকারীদের (কৃষক) কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেক্সটাইল শিল্পের মধ্যে এটা এখনও গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কথাও উঠতে শুরু করেছে।
এ ছাড়া, পণ্য শনাক্তকরণ, যথার্থ নির্ণয়করণ ও স্বচ্ছতার বিষয়ে নানা প্রশ্ন টেক্সটাইল কমিউনিটির আলোচনায় উঠতে শুরু করেছে। সম্প্রতি বেশি কিছু প্রতিবেদন ও নিবন্ধও প্রকাশিত হতে দেখা গেছে বিষয়টি নিয়ে। দুটি উদাহরণ এখানে হাজির করা যেতে পারে। একটি হলো, ২০১৯ সালের ৭ মে অ্যাপারেল ইনসাইডারে ‘টেকসই তুলা-পুনর্বিবেচনার এখনই সময়’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ইকোটেক্সটাইলের জুন-জুলাই সংখ্যায় ‘স্বচ্ছতা-দয়া করে পুনরায় চালু করুন, ব্যবসার জন্য এটা বিদায় ঘণ্টা’ শিরোনামে সংবাদ ছাপা হয়। তবে এই আলোচনায় একটি বিষয়ের ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। আর তা হলো শনাক্তকরণ, গ্রহণযোগ্যতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে যুক্ত পণ্যের খাঁটিত্ব নিয়ে বৃহত্তর আলোচনার এখনো বড় ঘাটতি। এই রকম কাজ করা আসলেই খুব কঠিন, তাই হয়তো হচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, সাপ্লাই চেন প্রথাগতভাবে একটি মৌলিক নিরীক্ষা পদ্ধতির নির্ভরশীল। এই মৌলিক নিরীক্ষা পদ্ধতিই সাপ্লাই চেনের পণ্যের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বিষয়টি দেখভাল করে। তাই এই বিষয়টি মোটের সুখকর নয়। এই কারণেই লম্বা আলোচনার পরও আমাদের আলোচনার শুরুতে ফিরতে হচ্ছে। ফিরতে হচ্ছে সেই ছোট পাঁচটি সাধারণ ছোট শব্দে, ‘এটা শুধু একটি বাক্সই’। পণ্যের খাঁটিত্ব নিয়ে আমরা এখনো সন্দেহের আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছি। কারণ, কীভাবে নিশ্চিত হব এটাই আসল পণ্য এবং এটার খাঁটিত্বের বিষয়ে নিশ্চয়তাই বা কই?
এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বাজারে ইতিমধ্যে বেশ কিছু প্রস্তাবও তুলে ধরা হয়েছে এবং সামনে আরও অনেক প্রস্তাব আসতে যাচ্ছে। সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে অথবা টেক্সাটাইল সাপ্লাই চেনের জন্য অতিরিক্ত স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে এসব প্রস্তাব আনা হয়েছে। এসব প্রস্তাবে মার্কার (চিহ্নিতকারী), ট্রেসার (শনাক্তকারী), সংযোজনকারী (অ্যাডিটিভস), আরএফআইডি, ডিজিটাল লেনদেনের সনদ, তৃতীয় পক্ষীয় প্রতিষ্ঠান এবং বøকচেইন, হোলোচেইনের মতো বৃহৎ ডেটা সংগ্রহকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে একটি মূল গ্রæপের পদ্ধতি ও প্রযুক্তির সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা যা এই সমস্যার সমাধান বাতলে দিতে কাজে দেবে।
কোম্পানি হিসেবে সুপিমা তাদের নিজেদের তুলাকে খাঁটিত্ব প্রমাণ করার একটি উপায় খুঁজতে এক দশকের বেশি সময় ধরে সংক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্লাটফর্ম বা প্রযুক্তি ব্যতীত পণ্যের খাঁটিত্বের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করে বিশ্বাসের ওপর। সাপ্লাই চেনগুলোর অধিকাংশই আসল পণ্য সরবরাহে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে। তবে যথা উপযুক্ত পদ্ধতি থেকে তারা এখনো অনেকটা দূরে এবং তাদের কাছে চাহিদার বোঝা চাপিয়ে রাখাও ঝুঁকিপূর্ণ। যদি কোথাও জবাবদিহিতা না থাকে তাহলে সেখানে সর্বদাই বিকল্প কিছু ঘটার পথ খোলা থাকে।
আমরা সবাই ভালোই জানি, টেক্সটাইল সাপ্লাই চেন কীভাবে কাজ করে এবং তাদের চ্যালেঞ্জগুলোই বা কী। পণ্য আদান-প্রদান ও কেনা-বেচায় বিভিন্ন স্থানে তাদের অর্থ ব্যয় করতে হয়। অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় তাদের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হিসেবে পরিণত হয়। চাঁদাবাজি বা জবরদস্তি চলাকালে কোম্পানিগুলো যখন নিজেদের টিকে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তখন উৎপাদন ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সৃজনশীলতার বিস্তার ঘটছে। পণ্যের উৎস, পণ্যের আসলত্ব নিরুপণ করার সক্ষমতা না থাকায় বিকল্প মাধ্যম হিসেবে এবং প্রতারণা ধরার জন্য এই সৃষ্টিশীল কাজের গুরুত্ব বাড়ছে। তবে সহজলভ্য এসব সৃজনশীল পদ্ধতিতে পণ্যের উৎসের বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য উপযোগী নয়।
ফরেনসিক বিজ্ঞানের ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্যের উৎসের সম্পর্কে উত্তর পাওয়া এবং সাপ্লাই চেনের মাধ্যমে আসা পণ্যের স্বচ্ছতা পরীক্ষা করে দেখার একটি উপায় রয়েছে। তুলা ও টেক্সটাইল শিল্পে এটা নতুন হলেও ইতিমধ্যে অন্যান্য পণ্যের উৎস প্রমাণ করতে ফরেনসিক বিজ্ঞান সফলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। সুপিমা নিউজিল্যান্ডের ফরেনসিক কোম্পানি অরিটেইনের সঙ্গে কাজ করছে বেশ কিছুদিন ধরেই। অরিটেইন কার্যকরী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে তুলার উৎপত্তি নিরুপণ করে থাকে। সুপিমা তুলা উৎপাদন এলাকার মানচিত্র এঁকে সুপিমা সব সুপিমা তুলার জন্য একটি উৎসগত ডাটাবেজ প্রণয়ন করেছে। এটা সুপিমার সব অংশীদারী প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হবে যাতে তারা এটি ব্যবহার করে সুপিমা থেকে কেনা তুলার মান, উৎপাদনের সত্যিকার উৎস নির্ণয় করতে পারে।
সহজ কথা বলতে গেলে, সুপিমায় ব্যবহৃত অরিটেইনের ফরেনসিক বিজ্ঞান পদ্ধতি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি শনাক্তকরণ উপাদান ব্যবহার করে যা তুলা উৎপাদনের পরিবেশের সঙ্গে একেবারে মানানসই। তুলা যেখানে উৎপাদিত হয়, সেই উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাটি, পানি, পরিবেশ থেকে শুরু করে খুঁটিনাটি বিষয় পরীক্ষা করে দেখা হয় এসব উপাদান ব্যবহার করে। এসব শনাক্তকরণ উপাদানের বিশ্লেষণী ক্ষমতা এতোটাই বেশি যে শুধু দেশগুলোর মধ্যে তুলা উৎপাদনের বৃহৎ ভূতাত্ত্বিক এলাকাকে আলাদা করতেই সক্ষম হয় না, অঞ্চল, উপ-অঞ্চলভিত্তিক তুলার মান ও ধরন বেশ সুক্ষ্মভাবে বিস্তারিত বিশ্লেষণও করতে পারে। এতে করে তুলা উৎস খুবই সহজেই শনাক্ত করা যায়। এই পদ্ধতি জৈব সুপিমা তুলা ব্যবহারকারী কেরিং গ্রুপে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের, এমনকি আশপাশের এলাকা থেকে আসা তুলার গুণগত মানের সঙ্গে সুপিমার তুলার গুণগত মান পরখ করে দেখা সহজ হবে। এতে করে তুলার মান নিয়ে থাকা সংশয়ও দূর হবে। তুলার উৎস নিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর প্রদানের উপায় বাতলে দিতে প্রথমবারের মতো সুপিমা ও অরিটেইন এই পদ্ধতি সফলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। তুলা উৎস ও উৎপাদন নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে যে নানা সংশয় ও উদ্বেগ রয়েছে, এই পদ্ধতি তার অনেকটাই দূর করবে বলে আশা।
লিখেছেন
মার্ক লিউকোউইজ
প্রেসিডেন্ট ও সিইও
সুপিমা
মার্ক লিউকোউইজ অলাভজনক প্রমোশনাল প্রতিষ্ঠান সুপিমার প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। প্রতিষ্ঠানটি আমেরিকান পিমা তুলা উৎপাদনকারী এবং যারা এই বিশেষ ও অনন্য তুলা ব্যবহার করে এমন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করছে।